ভালবাসি প্রকৃতি

ভালবাসি প্রকৃতি

Monday, October 14, 2019

আব্বার নদ ও স্বাস্থ্যচারণ!

কয়েকদিন যাবৎ শারীরিক অসুস্থতায় ভূগছিলাম। ঋতু বৈচিত্রের দেশ বাংলাদেশ। কিছুদিন আগেও প্রচন্ড গরমে ঘেমেছি, বৃষ্টিতে ভিজেছি। হঠাৎ করেই সেই গরম, সেই বৃষ্টি উধাও। রাত হলেই কুয়াশা নেমে আসে। ঘন কুয়াশা না হলেও একেবারে কম নয়। চারদিকে তাকালেই বুঝাযায় কুয়াশার হালহকিকত। বিশেষ করে দূরে তাকালে লাইটগুলোর চারদিকে কুয়াশার একটা আভা ফুটে ওঠে। চমৎকার একটা সময় যাচ্ছে। না গরম, না শীত। জীবনযাপনের জন্য এমন একটা আবহাওয়া কতটা উপভোগ্য তা বলে বুঝানো যাবে না। কিন্তু রাতের বেলা মটর সাইকেল চালালে শীতের আগমনী টের পাওয়ার মত। যারা হেলমেট না পড়ে মোটর সাইকেল চালায় তারা হাড়ে হাড়ে টের পায়। যদিও হেলমেট না পড়ে মটর বাইক চালানো ঠিক নয় সেটা ভুলে গেলে চলবে না!

প্রায় সপ্তাহখানেক অসুস্থতায় ভূগায় চেম্বারে শুধু আসা যাওয়া ছাড়া কোন কাজই করিনি। ঠান্ডায় মাথা ভার হয়ে ছিলো। নাক থেকে কখনো তরল নিস্কাশিত হয়েছে কখনোবা ঝড়েছে শ্লেষ্মা! এরই মাঝে দেশ থেকে ঝড়ে গেছে অদম্য মেধাবী আবরার। এতদিন ফেনী নদীর পানি ভারতের পাইপ দিয়ে গড়িয়েছে কত কিউসেক তার কোন হিসাব না থাকলেও এখন গড়াবে এক দশমিক বিরাশি কিউসেক বৈধভাবে এটা নিশ্চিত হয়েছে! তার মাঝে আমাদের রাজনীতিবীদরাও দিয়ে যাচ্ছে চরম বিনোদন! কেউ কেউ দাবী তুলছে ফেনী নদীকে ‘আবরার নদ বলে ডাকতে আর পাবলিক সেটাকে বুঝছে আব্বার নদ ডাকবে!

সম্প্রতি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ বুয়েটে ঘটে গেলো এক হৃদয় বিদারক ঘটনা। এক মেধাবী ছাত্রকে ছাত্র নামের কলঙ্ক কিছু ছাত্র পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। আমাদের দেশে সবচেয়ে মেধাবী ছাত্ররাই সাধারণত বুয়েটে পড়ার সুযোগ পায়। ব্যতিক্রম নেই সেটা বলবো না। অনেকেরই কলকব্জা নিয়ে ঘাটাঘাটির অরুচি থাকে। যারা শরীর নিয়ে চর্চায় আগ্রহী হয়, তারা মেডিকেলে ভর্তি হয়ে থাকেন। সেক্ষেত্রে বলাই যায়, দেশের সবচেয়ে মেধাবী যারা তারা বুয়েট বা মেডিকেলে পড়েন। অথচ বাস্তবতা এমন যে সেই বুয়েট বা মেডিকেল থেকে পাস করা দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীরা যখন জেলা-উপজেলা পর্যায়ে কাজ করতে আসেন তখন দেশের সর্বনিম্ন মেধাবীরা সেই সর্বোচ্চ মেধাবীদের চোখ রাঙ্গায়, কখনোবা গায়ে হাত তুলে, সোজা কথা মারধর করে, নাজেহাল করে। সেই তথাকথিত সর্বনিম্ন মেধাবী আর কেউ নয়, তারা রাজনীতির সাথে যুক্ত কিছু কুলাঙ্গার।

যাহোক, লালন সাঁইজীর স্মৃতিধন্য কুষ্টিয়া থেকে উঠে আসা অদম্য এক মেধাবী আবরার ফাহাদ। ছাত্র রাজনীতির পরশ পাওয়া কিছু বিশাক্ত কীট আবরারকে বেধরক পিটিয়ে মৃত্যুর কোলে শুইয়ে দেয়। আবরারের অপরাধ সে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু প্রশ্ন তুলেছেন এবং সে একটি ধর্মীয় উন্মাদনায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের সাথে জড়িত। যদিও তার বন্ধুরা নিশ্চিত করেছে আবরার সেই কথিত রাজনীতির সাথে জড়িত নয়। ছাত্র রাজনীতিতে প্রতিটি দলের কর্মকান্ডই আলোচিত-সমালোচিত। ধর্মীয় উন্মাদনায় বিশ্বাসী রগকাটা ছাত্র সংগঠনটি কতটা ভয়ংকর তা আমরা সবাই জানি। সময় বড় খারাপ যাচ্ছে তাদের, তাই সংগঠনটি মাথা চাড়া দিয়ে দাড়াতে পারছে না। যদি পারতো তবে এমন অনেক আবরার মাঝে মাঝেই সিড়ির উপর শুয়ে থাকতো গলা বা রগ কাটা অবস্থায়। ছাত্র রাজনীতির নামে এখন যা হচ্ছে তাও যে খুব ভালো কিছু হচ্ছে তা কিন্তু নয়, যা হচ্ছে সেটাও চরম খারাপ একটা পর্যায়ে পৌছে গেছে। একেকজন ছাত্রনেতা দানব আকার ধারন করছে। এখন দানবরা একপাক্ষিক ক্ষমতার মহড়া দিচ্ছে, সুযোগ পেলে অন্য ছাত্রনেতারাও ক্ষমতা দেখাবে। এতে খালি হবে মায়ের কোল, এর চেয়ে বেশি কিছু হবে বলে আমি মনে করি না। লেখাটা পড়ে হয়তো অনেকেই বলবেন, কোন দলের ছেলেরা মারছে তা উল্লেখ করছি না কেন! ভাসুরের নাম সবাই জানে, লয়না সরমে! আমিও জানি। নামটা বললে যারা খুশি হবেন তাদের অতীত ইতিহাসও বেশ সুখকর নয়, বললে তাদের মুখেও হাসি থাকবে না। তাই আমি দলের নাম না উল্লেখ করেই লিখলাম। যরা বুঝার তারা বুঝে গেছেন, যারা বুঝতে চান না তারা বুঝবেনও না।

অতি মেধাবীদের কিছু খেয়ালী উন্মাদনা আছে। সিনিয়ররা জুনিয়রদের নানান ভাবে নাজেহাল করে আনন্দ উপভোগ করে। অনেকটা পেয়ারের আরব শেখদের মতো, উটের পিঠে শিশু জকি বসিয়ে উন্মাদ আনন্দ উপভোগ করার মত। এটাকে নাকি র‌্যাগিং বলে! শিক্ষকরা কখনো জানে, কখনো জানে না। শিক্ষকরা একটু কঠোর হলে এধরনের আচরন থেকে দানবদের নিবৃত্ত করতে পারেন। সেটা তারা কখনোই করেন না। আর না করার কারনও আছে। শিক্ষকরা লাল-নীল-সাদায় জড়িয়ে তাদের বিবেকের খাতা সাদা করে রেখেছেন, শুন্য করে রেখেছেন বুকের সাহসও। তাই জেনে শুনেও তারা র‌্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারেন না অথবা করেন না! আর সবাইতো থ্রি-ইডিয়ট মুভির র‌্যাঞ্চোদাস শ্যামলদাস চ্যাঞ্চাদ হতে পারেন না! তাই সিনিয়দের কথামত বিনোদন না দিলে সারা মাস নিরীহ ছাত্রটির গায়ে বা বিছানায় মুত্র বিসর্জন করে চলে তথাকথিত সিনিয়র দানবরা! কখনো কখনো নিরীহ ছাত্রদের উপর চলে ক্রিকেট ব্যাট, স্ট্যাম্প, বেইসবল ব্যাট আর হকিতো এখন মাঠে থেকে বেশি ব্যবহার করেন ছাত্রনেতারা তাদের হল নিয়ন্ত্রণে। এদের আচরনে পরিবর্তন আনা এখন সময়ের দাবী হয়ে দাড়িয়েছে। রাজনীতি বন্ধ করে, না অন্য কোন পদ্ধতিতে দানবের ক্রিয়াকর্ম রোধ করবে সেটা নীতি নির্ধারকদের বিষয়। আমরা চাই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, একটি সুন্দর পরিবেশ, যেখানে কোন হৈচৈ থাকবে না। যেখানে তৃষ্ণার্ত ছাত্রকে আরেক ছাত্র ঢেলে দেবে পানি!

ভারত আমাদের অতি পুরাতন মিত্র। এই বিষয়ে কারো কোন ভিন্ন মত নেই। অবশ্য ধর্মান্ধ-পাকিস্তানপ্রেমীদের কথা আলাদা। যারা ধর্মের ভিত্তিতে বন্ধু নির্বাচন করেন তাদের কথা আলাদা। কিন্তু সেই পুরাতন মিত্ররা মাঝে মাঝে এমন কাজ করে যা জাতিকে হতবাক করে দেয়। তিস্তা নিয়ে ধস্তাধস্তি চলছে বহুকাল থেকে। সেই তিস্তা চুক্তি সই করার জন্য কলম রেডি, চুক্তি রেডি এমনকি কলমের মুখও খোলা থাকে কিন্তু সই হয় না অজানা কারনে! কখনো দরকষাকষিতে মিলে না, কখনো দিদির সম্মতি মিলে না! আমরা এমনিতেই পানি সংকটে ভূগছি। তিস্তা তিস্তা করে আমাদের গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, শুকিয়ে যাচ্ছে দেশের কোন কোন অংশও, হয়ে যাচ্ছে মরুভূমি। অথচ আমাদেরই ফেনী নদী থেকে সেই মিত্ররা তাদের দেশের তৃষ্ণার্তদের খাবার পানির যোগান দিতে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে, নীতিবহির্ভূত পদ্ধতিতে, গায়ের জোরে পাম্প বসিয়ে পানি তুলে নেয়। সম্প্রতি বিষয়টা সামনে আসলে আমাদের প্রধানমন্ত্রী তার মানবিক চিন্তা থেকে হোক বা সমালোচকদের ভাষায় অন্য কোন কারনেই হোক পানি নেয়ার জন্য অনুমোদন দিয়ে আসেন, যা বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়। আমাদের সল্প সম্পদ নিয়ে আমরা মানবিকতার পরিচয় দিয়ে তৃষ্ণার্তের মুখে পানের পানি দিতে পারি দেখিয়ে আসলাম আর বিশাল পানি নিয়েও তারা আমাদের তিস্তা চুক্তিতে সই করতে পারে না! অথচ চুক্তিটি যৌক্তিক ও ন্যাহ্য দাবী। আসলে আমাদের মন কতটা বড় এতেই বুঝা যায়! তিস্তা চুক্তি না হওয়া, ফেনী নদীর পানি নেয়ায় সম্মতি দেয়া, এসব বিষয়ে কতটুকু লাভ হলো-কতটুকু ক্ষতি হলো সেটা আমাদের দেশের পানি বিশেষজ্ঞরা ভালো বলতে পারবেন। এ বিষয়ে আমার মতামতের কোন গুরুত্ব নেই এটাই বাস্তবতা।

আমাদের রাজনীতিবিদরা বেশ রসিক। এরা কথায়-কাজে, আচার-আচরণে মাঝে মাঝেই তার পরিচয় দেন। বিভিন্ন ইস্যূ নিয়ে আমাদের রাজনীতিবিদরা বেশ রস সঞ্চার করে দেখে মজাই লাগে! মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা নিয়েও নেতারা রস করতে থামেনি। কোন এক নেতা নাকি দাবী তুলেছেন, ফেনী নদীর নাম পরিবর্তন করে ‘আবরার নদ রাখা হোক! আমাদের দেশে সবাই নেতা, সবাই বক্তা, সবাই সঞ্চালক। চায়ের দোকানে বসলে বুঝাযায় দেশে কত বুদ্ধিজীবী আছে। দেশের সবচেয়ে বড় টকশো অনুষ্ঠিত হয় চায়ের দোকানেই। আর প্রযুক্তির কল্যানে এখন প্রতিটি চায়ের দোকানে একটি করে টেলিভিশন থাকে, সাথে থাকে ডিশের লাইনও। চায়ের দোকানের টকশো থেকে বেরিয়ে এক লোক বলছে-নেতারা কীযে কন বুঝি না! এতকালের ফেনী নদীকে এখন নাকি ‘আব্বার নদ বলতে হবে! কথা শুনে বুঝতে বাকী থাকে না, সে ‘আবরার নদ বুঝাতে চাইছে। রাজনীতিকরা সকল বিষয়েই রাজনীতি করবে এটাই সাভাবিক। তবে ঘর পোড়ার পর আলুপোড়া বা খৈ খাওয়ার অভ্যাসটা ছাড়তে হবে। দেশে ছাত্রহত্যা, দেশ বিরোধী চুক্তি যে যাই বলেন না কেন তা কী শুধু এখনই হচ্ছে? নিজেদের সময়কার ভূমিকা নেতারা বেমালুম ভুলে যান। অতীতকে মনে রাখেন না। সামনে তাকিয়ে কথা বলেন, পিছনে তাকালে দেখবেন সমালোচনার কাজগুলো করে এসেছেন আপনিও। আমরা বিনোদন চাই না, আমরা ছাত্র রাজনীতির আড়ালে দানবের উত্থান চাই না, আমরা দেশবিরোধী চুক্তি চাই না। আমরা আসলে কী চাই? আমরা চাই সুস্থ্য ও সাভাবিক ভাবে বাঁচতে, সাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই। এই চাওয়াটা কী খুব বেশি চাওয়া?

Tuesday, September 10, 2019

নদীও কী কয়েন চেনে!

রথ দেখা ও কলা বেচার কথা আমরা সবাই জানি। এক শুক্রবার সমাজ পরিবর্তনে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও সুকান্ত’র সহিত্য শীর্ষক আলোচনা সভার আয়োজন করেছিলো বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘ শরীয়তপুর জেলা শাখা। আমি যেহেতু সংগঠনের শরীয়তপুর জেলা শাখার সভাপতি তাই যথারীতি আমার সভাপতিত্বেই অনুষ্ঠিত হবে আলোচনা সভা। অপরদিকে ঐ শুক্রবারই আমার এক শ্যালিকার বিবাহোত্তর বরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে রাজধানী ঢাকায়। যেহেতু সংগঠন করি তাই আলোচনা সভায় উপস্থিত থাকার বিষয়টাই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ চলছিলো। হঠাৎ বিপত্তি বাঁধলো। আমার এক ঘনিষ্ট বন্ধু শামীম সরদারের বাবা হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পরলো। তাকে নিয়ে বৃহস্পতিবার বিকালেই ঢাকা রওয়ানা দিতে হলো আমাদের। শরীয়তপুর থেকে কাঁঠালবাড়ি ফেরিঘাট দিয়ে ঢাকা পৌছানোর রাস্তার দূরত্ব কম হলেও এই রুটে সময় লাগে বেশি। সময় মত ফেরি পাওয়া যায় না, ফেরি পাওয়া গেলেও সিরিয়াল নিয়ে সমস্যা, তার উপরে মাওয়া থেকে ঢাকার রাস্তা নির্মানাধীন হওয়ায় প্রচুর জ্যামের কবলে পরতে হয়। বিশেষ করে এক ভিআইপির কারনে এক ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনায় এখন সিরিয়াল নিয়ে কোন মানবিকতাও দেখায় না ফেরি কর্তৃপক্ষ। আরিচা দিয়ে ঢাকা ঢুকতে চাইলে দূরত্ব বেশি হয়ে যায়, তবুও আমরা বিরতিহীনভাবে যাওয়ার জন্য শরীয়তপুর থেকে মাদারীপুর-ফরিদপুর-গোয়ালন্দ-আরিচাঘাট-মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকা ঢুকলাম। কোন প্রকার বিরতি ছাড়া গাড়ি চালিয়ে গাবতলি হয়ে পৌছে গেলাম জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট। রাত চারটা পর্যন্ত জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে দাড়িয়ে থেকে ভোরের দিকে একটি হোটেলে উঠে একটু গা এলিয়ে দেয়া ছাড়া কোন কাজ ছিলো না হাতে। ঢাকা যেহেতু এসেই পরেছি তাই শ্যালিকার বিয়ের অনুষ্ঠানে চলে গেলাম পরদিন সন্ধায়। রাতের অনুষ্ঠান শেষে তার পরদিন শনিবার সকালে শরীয়তপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়ে বিকাল নাগাদ মাওয়া ঘাটে এসে নদী পার হওয়ার জন্য লঞ্চে উঠেছি।
প্রমত্তা পদ্মার তেজ যে এখনও আছে তা সময় সময় বুঝিয়ে দেয়। ঘাট থেকে লঞ্চ ছারার পর একটু এগুতেই শুরু হলো লঞ্চের দোলানি। সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে লঞ্চ আর ডানে বামে দোলছে বিশাল হাতির পথ চলার মত। প্রমত্তা পদ্মার কাছে লঞ্চটা ছোটই মনে হলো। যারা লঞ্চের পিছনের দিকে আছে তারা সবাই সতর্ক হয়ে নড়ে চড়ে বসলো। যে যা পাচ্ছে তাই ধরে শক্ত হয়ে বসছে। ঝালমুড়ি, চিড়াভাজা বিক্রেতারাও লঞ্চের সাথে ঠেকনা দিয়ে নিরাপদে থাকার চেষ্টা করছে। আমি লঞ্চে উঠলে সাধারণত বসতে ভালো লাগে না। বেশিরভাগ সময়ই দাড়িয়ে নয়তো হেটে কাটিয়ে দেই। আমি লঞ্চের রেলিং ধরে দাড়িয়ে আছি। লঞ্চের দোলনিতে লঞ্চের ভেতরে বসা অনেককেই দেখলাম ভয়ের কারনে মুখ শুকিয়ে গেছে। বিশেষ করে মহিলারা বেশ ভয় পাচ্ছে ঢেউয়ের আঘাত দেখে। তবে সবাই যে ভয় পাচ্ছে তা কিন্তু নয়। যারা এ রুটে নিয়মিত যাতায়াত করেন তাদের কাছে এটা কোন বিষয়ই না। আমার কাছেও তেমন ভয়ের কিছু বলে মনে হয়নি।
লঞ্চের দোলনি দেখে ভিতর থেকে এক বৃদ্ধ মহিলা রেলিংয়ের কাছে এসে নদীতে পাঁচ টাকা মূল্যমানের চকচকে রুপালী কয়েন ফেলছে! কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে দিয়ে সে তিনটা কয়েন ফেললো। ভয়ার্ত মুখে দোয়া পড়ার ভাবও দেখা গেলো বৃদ্ধ মহিলার। কয়েন ফেলার কিছুক্ষণের মধ্যেই থেমে গেলো পদ্মার ঢেউ, লঞ্চের দোলনি! তাহলে কী নদী এবং নদীর ঢেউও কয়েন চেনে?
ভাবছেন, কয়েন ফেলার পরই প্রমত্তা পদ্মার ঢেউ থেমে গেলো! আসলে বিষয়টা তা নয়। কয়েন ফেলতে ফেলতে লঞ্চ চলে এসেছে মূল নদী থেকে মোহনায়। মূল নদী পেরিয়ে মোহনায় ঢোকার পরে নদী অত্যন্ত সরু খালের মত হয়ে গেছে। সরু খালের মধ্যে আসার সাথে সাথে ঢেউও কমে যায়, দোলনিও কমে যায়। আমার পাশে দাড়িয়েই বৃদ্ধ মহিলা কয়েন ফেলেছে কিন্তু আমি কিছুই জিজ্ঞেস করিনি। জিজ্ঞেস না করার কারনও আছে।
নদীতে কয়েন ফেলার দৃশ্যটা আমার কাছে অতি পরিচিত। আমরা একসময় রাজধানী ঢাকা যেতাম লঞ্চে করে। বর্ষার দিনে কোটাপাড়া লঞ্চ ঘাটেই লঞ্চ আসতো। আর শুষ্ক মৌসুমে লঞ্চ থাকতো নড়িয়া উপজেলার বাশতলা, চন্ডিপুর, সুরেশ্বর ঘাটে। তখন লঞ্চ প্রচুর ঢেউয়ের মুখে পড়তো। এখনতো পদ্মা অনেকটাই মরে গেছে! সেই মরা পদ্মাও মাঝে মাঝে যে খেল দেখায় তা নড়িয়ার মানচিত্রের দিকে তাকালেই অনুমেয়। নড়িয়ার মানচিত্র অবশ্য ঠিকই আছে। শুধু স্থল ভাগের পরিমান কমেছে। পদ্মার যৌবনে কেমন ঢেউ ছিলো তা সিনিয়র সিটিজেনরা হয়তো ভালো বলতে পারবে। লঞ্চে ঢাকা যাওয়ার সময় দেখতাম ঝড়ের কবলে পরলে বা ঢেউয়ের মুখে পরলে বৃদ্ধ মহিলা, পুরুষ সবাই নদীতে পয়সা ফেলতো। তখন দেশে পাঁচ পয়সা, দশ পয়শার কয়েন প্রচলিত ছিলো। এখন অবশ্য পাঁচ পয়সা বা দশ পয়সার দিন শেষ। পাঁচ-দশ পয়সাতো দূরের কথা এক টাকার একটা কয়েনে এখন একটা লজেন্স বা চকলেটও পাওয়া যায় না! তখন সাধারণ মানুষের মনে একটা বিশ্বাস ছিলো যে, পাঁচ-দশ পয়সা নদীতে ফেললে নাকি নদী শান্ত হয়।
আজ এতটা বছর পরেও অশান্ত নদীকে শান্ত করতে কয়েন ফেলা দেখে অবাক হইনি। মানুষ এখনও কত বোকা রয়ে গেছে। একবিংশ সতাব্দীতে এসেও ভয়ের কারনে নদীকে বা নদীর ঢেউকে টাকার লোভ দেখিয়ে শান্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। যদিও এধরনের কাজ এখন অনেক কমে গেছে। তারা এখন বোঝে ঢেউ থামাতে বা ঝড় থমাতে পয়সা ফেলা মানে টাকাটা জলে ফেলারই নামান্তর। প্রকৃতি কখনো ঘুষ খায় না, ঘুষ খায় মানুষে। প্রকৃতিকে আমরাই ক্ষেপিয়ে তুলেছি। নির্বিচারে গাছ কেটে, নদীর তীরের মাটি কেটে, জীব বৈচিত্র ধ্বংস করে আমরা প্রকৃতির বারোটা বাজিয়ে ছেরেছি। এখন প্রকৃতি যদি দু’একটু খেলা দেখাতে চায় তবে তাকে পয়সা দিয়ে থামানো যাবে না। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিপূরণ দিতে গিয়ে কোটি কোটি ডলার খরচ করে উন্নত দেশগুলো। জলবায়ু সম্মেলনের পরে ঘোষণা আসে কে কত ডলার দিবে। প্রকৃতি ধ্বংস করে ক্ষতিপূরণ দেয়ার নামে আসলে বড় বড় এনজিওগুলোকে, ছোট ক্ষমতাধর দেশগুলোকে ভিক্ষা দেয়। দুহাত ভরে সে ভিক্ষা নিয়ে আমরা দাতাদের গুনকির্তন করি। ধন্য ধন্য সাড়া ফেলি, মুখে ফেনা তুলি তাদের দানের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে গিয়ে। প্রকৃতিকে শান্ত করতে হলে প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। প্রকৃতির প্রতি বিরুপ হলে প্রকৃতিও আমাদের উপর বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখাবে। যে কয়েন নদীতে ফেলা হলো এটাও প্রকৃতির প্রতি একটা বিরুপ আচরণ। নদী কয়েন দিয়ে কী করবে? নদীতো শপিং করে না, নদী কাউকে ঘুষও দেয় না। কয়েনটা নদীর বুকে জগদ্দল পাথর হয়ে চেপে থাকবে নিঃশেষ হওয়া পর্যন্ত। কুসংস্কার থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। বিজ্ঞান ভিত্তিক চিন্তা চেতনা হৃদয়ে ধারণ করে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিতে হবে এবং প্রকৃতিকে বাঁচাতে হবে। প্রকৃতি বাঁচলে আমরাও বাঁচবো। আসুন প্রকৃতির প্রতি সদয় হই।

asadjewel@gmail.com, www.asadjewel.com

Saturday, August 31, 2019

মেঘনার জল, করে টলোমল...

শুক্রবার আমার কাছে ঘুম দিবস! সারা সপ্তাহ যদি ঘুমাই, তার পরেও বৃহস্পতিবার দিনটি আসলে চেম্বারের সকল কাজই আমার কাছে অসাড় লাগে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই শরীর ও মনে একটা ছুটি ছুটি ভাব থাকে। সেই স্কুল জীবনে যেমন মনে হতো, আজ বৃহস্পতিবার হাফ ক্লাস! দুপুরেই ছুটি! আজ তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে খেলাধুলা করা যাবে! অথবা রমজানের আগের সময়টা যেমন সামনেই একমাস ছুটি! ঠিক তেমনি বৃহস্পতিবার ছুটি আনন্দ ছারা মাথায় আর কোন কিছু কাজ করে না। বৃহস্পতিবার রাতে একটু বেশি সময় টিভি দেখা, রাত জাগা। অতপর গভীর রাতে ঘুমোতে যাওয়া এবং অনেক বেলা করে ঘুম থেকে ওঠা! তাই বলে প্রয়োজনে যে শুক্রবারেও আগে আগে উঠি না তা কিন্তু নয়। আজ শুক্রবার সকাল সকাল ঘুম ভাঙ্গে শিশু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মাহবুবুল হকের ফোনে। ফোন রিসিভ করতেই জানিয়ে দিলো আজ বারোটার দিকে চাঁদপুর ঘাটে যাবো। আমাকেও সঙ্গী করতে চায়। আমার যেহেতু ঘোরাঘুরির বাতিক আছে তাই এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম।
বারোটায়ই চলে এলাম বন্ধুর বাড়ি। কিন্তু যথারীতি বারোটায় আমরা রওয়ানা দিতে পারলাম না। সারে বারোটায় রওয়ানা দিলাম আমরা। সফর সঙ্গী হিসাবে আরো যোগ দিলো বন্ধু মানিরুল ইসলাম, এডভোকেট জালাল আহম্মেদ সবুজ সাথে গাড়ির দায়িত্বে আছেন বুলবুল। গুটি বসন্ত হলে যেমান গালে গর্ত হয়ে যায় ঠিক তেমনি গুটি বসন্তে আক্রান্ত রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে এক পর্যায়ে বিরক্ত বোধ করছিলাম। ভেদরগঞ্জ থেকে ডামুড্যার সংযোগ সড়কের কাছে গিয়ে খোজ খবর করছিলাম ভালো রাস্তা আছে কোন দিক দিয়ে। একজন আমাদের দেখিয়ে দিলো-মোল্লার হাট দিয়ে একটা রাস্তা আছে যেটা দিয়ে অনেকটা ভালো রাস্তা পাওয়া যাবে। আমরা মোল্লারহাট ব্রিজ পার হয়ে গ্রামীণ রাস্তা দিয়ে ছুটে চলেছি দূর্বার গতিতে। শুক্রবার রাস্তা একদম ফাঁকা। রাস্তার দুই ধারে সবুজ আর সবুজ। মাঝে মাঝে সুদৃশ্য বাড়ি আর পুকুর। কিছু দুর পর পর একসাথে চার-পাঁচটা বাড়ি আবার সবুজ আর সবুজ। রাস্তা এক পর্যায়ে আবার গুটি বসন্তে আক্রান্ত রাস্তায় গিয়ে মিশে গেলো। আমরা হরিনাঘাট গিয়ে একটি হোটেলের সামনে গাড়ি রেখে ইলিশ ভাজা দিয়ে ভাত খেলাম। পেট ঠিক তো সব ঠিক। খাওয়া দাওয়ার পর এবার চিন্তা ভাবনা চলছে কি করা যায়! আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম ওপার যাবো।
চাঁদপুর মাছের বাজারের বেশ সুনাম আছে। সিদ্ধান্ত নিলাম ট্রলার দিয়ে মেঘনা পার হয়ে চাঁদপুর মাছঘাটে যাবো। কিন্তু হরিনা ঘাটে কোন ট্রলার পাওয়া গেলো না। ঘাট থেকে এখনই ফেরি ছাড়বে। খোঁজ নিয়ে জানা গেলো ওপার ফেরিঘাট থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে চাঁদপুর মাছঘাট। আমরা ফেরিতে উঠে গেলাম। ফেরির একদম সামনের দিকে দাড়িয়ে গেলাম। ফেরিতে পণ্যবাহী ট্রাক ছাড়া বাকী যে কয়টা বাস ও মাইক্রো বাস উঠেছে সবই চট্রগ্রামের ফটিকছড়ি যাবে। মাইজ ভান্ডারির ভান্ডার শরীফ যাওয়ার জন্য রওয়ানা দিয়েছে। গাড়িতে ভান্ডার শরীফের ফ্ল্যাগ পত পত করে উড়ছে। বাসের ছাদে ভান্ডার শরীফের গুণকির্ত্তন করে গান বাজছে। সব গানই জিকিরের সাথে! বাতাশ খেতে খেতে নদীর দুই ধারের হোগলার বন দেখতে দেখতে আমরা বিনা ভাড়ায়ই পৌছে গেলাম চাঁদপুর ফেরিঘাট। ফেরিঘাটে পৌছাতে পৌছাতে জোয়ার এসেগেছে। ফেরির পল্টুনের গোড়ায় হাটু পানি জমে গেছে। ভান্ডার শরীফগামী বাসে উঠে পানি পার হয়ে মোড় থেকে সিএনজি নিয়ে চলে গেলাম চাঁদাপুর শহরে ব্রিজের গোড়ায়। সেখান থেকে ইজিবাইক নিয়ে মাছ ঘাটে গিয়ে দেখি এলাহি কান্ড। ইলিশ আর ইলিশ! যেদিকে তাকাই শুধু ইলিশ মাছ! বড় বড় মাছ ধরা নৌকা ঘাটে নোঙ্গর করা আছে। টুকরি ভরা মাছ নিয়ে আড়তে এসে স্তুপ করছে শ্রমিকরা। আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম মাছের দৃশ্য। মাছের দাম তুলনামূলক বেশি দেখে বন্ধু মাহবুব কিছু মাছ কিনলো। ককসিটে বরফ দিয়ে ভালো করে প্যাক করে দিলো বিক্রেতা। এবার ফেরার পালা। মাছ দেখতে দেখতে সন্ধা ঘনিয়ে এসেছে। যাওয়া নিয়ে টেনশন দেখা দিয়েছে। রাতের আধারে ট্রলারে যাওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত হবে চিন্তা করলাম আমরা। কিন্তু যেভাবে এসেছি সেভাবে যেতে চাইলে রাত দশটা বেজে যাবে নদী পার হতেই। আমরা ট্রলার ঘাটে গিয়ে একটা ট্রলার নিলাম। আসল মজাটা হলো ট্রলারেই।
রাতের আঁধারে মেঘনা নদীতে ট্রলারে ভ্রমণ এতটা মন মুগদ্ধকর, প্রশান্তিদায়ক, আনন্দময় হতে পারে চিন্তা করিনি। মাথার উপর তাঁরা ভরা বিশাল আকাশ। দূর আকাশে তাঁরারা চেয়ে আছে আমাদের দিকে। চাঁদপুর থেকে ফেরার পথে চাঁদের দেখা না পেলেও তাঁরারা আমাদের হতাশ করেনি। অসংখ্য উজ্জল তাঁরার উপস্থিতি আমাদের পূলকিত করেছে বেশ। ট্রলারের বেঞ্চে বসে ছোট বড় ঢেউ এর ধাক্কা বেশ ভালোই লাগছে। ঢেউয়ের ধাক্কা বেশি শক্তিশালী হলে অবশ্য প্রাণ আর বুকে থাকতো না! মূল নদী পার হয়ে তীরের কাছ দিয়ে ছুটে চলেছে ট্রলার। কাশবন, হোগলা বনে ঘেরা চর। বাতাশে দুলছে বন। আমরা এগিয়ে চলেছি তীর ঘেষে। মূহুর্তেই যেন পৌছে গেলাম হরিনাঘাটে। যাওয়ার সময়টা যেমন দীর্ঘ লেগেছিলো আসার সময়টা মূহুর্তে শেষ হয়ে গেলো। আসলে ভালো সময় বেশিক্ষণ থাকে না। কষ্টের সময় শেষ হতে চায় না। আমরা হরিনাঘাট থেকে মেঘনা নদীর মধুর স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতে চলে এলাম শরীয়তপুর সদরে। বিদায় বেলায় তাই কিছু পঙতিমালা দিয়ে শেষ করতে চাই-
মেঘনার জল করে টলোমল
বয়ে চলেছে নিরবধি
রূপে তাহার মোহিত হয়ে ভাবি,
বার বার যেতে পারতাম যদি!

Thursday, August 29, 2019

খাস কামরা

খাস কামরায় খাস জমি
করতে গিয়ে চাষ
বড় বড় মহারথির
হয়েছে সর্বনাশ!
উত্তেজনায় বিবেক বুদ্ধি
লোপ পায় যখন
ঘরের বিরিয়ানি রেখে
পান্তা খায় তখন।
পান্তা খেয়ে পেট নষ্ট
ইজ্জত গেলো জলে
ন্যাংটোর নেই লজ্জার ভয়
সর্ব লোকে বলে।
ইজ্জাত কামালে বহু
শ্রম ও ছলা কলায়
একটু খানি ভুলে আজ
নেমেছে নীচতলায়।

Wednesday, August 28, 2019

ফুসফুস জ্বলছে...

ফুসফুসে ধরছে আগুন, কলিজায় লাগে তাপ
অন্য অঙ্গ টের পাচ্ছে, লাগছে অল্প ভাপ
কলিজা পুড়ে ছাই হলেই, অসাড় হবে দেহ
নিজের দেহে লাগাই আগুন, দেখছে নাতো কেহ!
নখ কাটি, আঙ্গুল কাটি, কাটি দেহের ত্বক
কাটাকাটির অভ্যাসটা, মোদের পুরনো সখ
ধ্বংস করছি নিজেকে নিজে, দেহ কাঁদছে নিরবে
দেহেরও ধারণে সীমা আছে, নিরবে কতটা সইবে?
অক্সিজেনের সিলিন্ডারে আজ, লাগছে ভীষণ আগুন
নেভানোর কোন গরজ দেখিনা, পুড়ে খাচ্ছে বেগুন
সিলিন্ডারে কোপ মেরে আজ, করছি তাতে ফুটো
কালচে বর্ণ ধারণ করছে, গোলাপী ফুসফুস দুটো?
এমন করে করতে থাকি, যদি নিজের ক্ষতি
একদিন ঠিক থাকবে নাকো, বাঁচার কোন গতি
অক্সিজেনের আধার ধ্বংসে, অধম জুয়েল ভাবে
নিজের ক্ষতির বিষয় নিয়ে, ভাববে মানুষ কবে?
পৃথিবীর ফুসফুস জ্বলছে আজ, রক্তাক্ত বাংলার ফুসফুস
কেউ খায় আলুপোড়া-খৈ, কারো নাই তাতে কোন হুস!

Monday, August 26, 2019

বাঙ্গালির তেলবাজী! তেল কচলিয়ে তেলচিটচিটে...

তেল এমন একটা অপরিহার্য দ্রব্য যা আমাদের জীবনে প্রতিনিয়ত প্রয়োজন হয়। তেল নিয়ে বহু লেখা প্রথিতযশা লেখকরা লিখে তেল বিষয়টাকেই তেলতেলে করে ফেলেছেন। আমি কচলিয়ে আরেকটু তেলচিটচিটে করলে কী দোষ! উপযুক্ত যোগ্যতা না থাকা স্বত্বেও সমাজে অনেকে অনেক ভালো জায়গায় অবস্থান করছে। সেটা সম্ভব হচ্ছে তেলানোর গুনে। একুশ শতকে এসে তেলানোটা একটা শিল্প মনে হচ্ছে। যে যত ভালো তেল মালিশ করতে পারবে সে তত উপরে অবস্থান করবে। আর আপনি যদি একবার উপরে বসে তেলাতে পারেন তাহলে যোগ্য-অযোগ্য কেউ আর উপরে উঠতে পারবে না, কারন আপনি আগেই তেলিয়ে তেলতেলে করে রেখেছেন। সেই সাথে আগন্তুকের পিছনে থাকবে বিশাল লাইন। যতটা উঠার চেষ্টা করবে, কিছুদুর উঠার পরে দেখবেন একজনের পা ধরে আরেকজন, আরেকজনের পা ধরে আরেকজন এভাবে ঝুলছে। একপর্যায়ে আগন্তুকরা ঠিকই পতিত হবে আপনি থাকবেন বহাল তবিয়তে। তেলের গুরুত্ব যারা বুঝতে পারে তাও যথাসময়ে সে’ই চূড়ায় অবস্থান করে। হাতে তেল থাকলেই হবে না, তেল সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায়, সঠিক পদ্ধতিতে মাখতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, বেশি পিচ্ছিল করলে আপনিও পিছলে না পরেন। তেলিয়ে পিচ্ছিল করলে তেলও আপনাকে ক্ষমা করবে না। তেলের কাজই উপরে উঠানো এবং সুযোগ পেলে পিছলে ফেলা।
তেল নিয়ে এত কথা বলার আগে তেলকে একটু তেলিয়ে নেয়া উচিত। তেলের প্রশংসা, তেলের উৎপত্তি, তেলের প্রকারভেদ জানা থাকলে আপনি তেলিয়ে মজা পাবেন, যাকে মাখবেন সেও মজা পাবে। তাই আগে তেলকে ভালোভাবে জানুন। তেল এমন কোন বস্তু যা সাধারণ তাপমাত্রায় তরল অবস্থায় থাকে। এটি পানির সাথে মেশে না; অথচ জৈব দ্রাবকের সাথে মিশে যায়। তেলে উচ্চমাত্রার কার্বন এবং হাইড্রোজেন রয়েছে। বিভিন্ন প্রকারের তেল হয়, যেমন: উদ্ভিজ্জতেল, ঔষধি তেল এবং অপরিহার্য উদ্বায়ী তেল প্রদত্ত সাধারণ সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত। সবধরণের তেলই আদিতে জৈব পদার্থ থেকে উৎসরিত। তেলের নামকরণঃ বাংলায় তেল শব্দটি এসেছে তৈল থেকে। তেলের ইংরেজি Oil এর ব্যবহার প্রথম লক্ষ্য করা যায় ১১৭৬ সালে যা পুরাতন ফরাসি শব্দ oile থেকে আসে। oile এসেছে লাতিন oleum থেকে। অলিয়াম এসেছে গ্রীক ἔλαιον (এলায়ন) থেকে যার অর্থ জলপাই তেল আর এলাইয়া অর্থ জলপাই গাছ বা ফল।
প্রকারভেদ নিয়ে আলোচনা করলে কালি ও কলম শেষ হবে প্রকারভেদ লেখা শেষ হবে না। তবে উল্লেখযোগ্য কিছু তেলের কথাতো বলাই যায়। যেমন খনিজ তেলঃ খনিজ তেল ভূ-অভ্যন্তরের সচ্ছিদ্র পাথরের স্তরে পাওয়া যায়। এই খনিজতেল বিভিন্ন জৈব পদার্থ, যেমন আদিকালে সমুদ্র তলদেশে জমে থাকা মৃত প্লাংকটন, থেকে উৎপন্ন হয়েছে। ভূ-অভ্যন্তরে এভাবে জমা থাকা অবস্থায় বিভিন্ন জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে এসব বস্তু খনিজ তেল বা পেট্রোলিয়ামে রূপান্তরিত হয়েছে। এসব তেলকে খনিজ তেল হিসাবে শ্রেনীভুক্ত করার কারণ মানবজাতির উদ্ভবেরও বহু আগে এই তেল সৃষ্টি হয়েছে এবং এগুলো ভূগর্ভের বিভিন্ন স্থান যেমন: পাথরের স্তর, বালুর স্তর বা ফাপা স্থান থেকে আহরিত হয়। এসব ছাড়ারও অন্য অনেক ধরণের তৈলাক্ত পদার্থ প্রকৃতিতে পাওয়া যায়, এর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত হল পীচ। এটি স্বাভাবিক ভাবেই মাটির নিচে বা আলকাতরার খনির যেখানে ফাটল আছে সেখানে পাওয়া যায়। পেট্রোলিয়াম এবং অন্যান্য খনিজ তেল (যা পেট্রোকেমিকেল নামেও পরিচিত) বর্তমান সময়ে মানব সভ্যতার জন্য এতই গুরুত্বপূর্ণ সম্পদে পরিনত হয়েছে যে, এগুলোকে সর্বব্যাপী শুধুমাত্র তেল নামেই অভিহিত করা হয়। জৈব তেলঃ জৈব তেল গুলোও উদ্ভিদ, প্রাণী এবং অন্যান্য জীব থেকে জৈবিক প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন হয় এবং এসব তেলের প্রকারভেদ অনেক। রাসায়নের পরিভাষায় তেল একটি অস্পষ্ট শব্দ। পক্ষান্তরে তেল, চর্বি, মোম, কোলেষ্টরেল এবং জীব ও জীব নিসৃত তরল থেকে প্রাপ্ত অন্যান্য তৈল জাতীয় পদার্থকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় লিপিড বা চর্বি জাতীয় পদার্থ (ইংরেজি: Lipid)। লিপিড গুলিকে (যা মোম থেকে স্টেরয়েড পর্যন্ত হতে পারে) নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য দিয়ে বর্ণনা করা কঠিন। তবে একটি দিক থেকে এদের মধ্যে মিল রয়েছে, আর তা হল-এসকল পদার্থ কখনো পানিতে মেশে না বা দ্রবীভূত হয় না অথচ সহজেই অন্য লিপিডের সাথে মিশে যায়। এসব পদার্থের মধ্যেও উচ্চমাত্রার কাবর্ণ ও হাইড্রোজেন থাকে তবে অক্সিজেনের পরিমাণ অন্যান্য জৈব যৌগ বা খনিজ থেকে কম। সিনথেটিক তেলঃ সিথথেটিক তেল একধরণের পিচ্ছিলকারক যা কৃত্রিমভাবে পেট্রোলিয়াম নয় এমন ধরণের রাসায়নিক যৌগ দ্বারা প্রস্তুত করা হয়। সিনথেটিক তেল পেট্রোলিয়াম থেকে পরিশোধিত পিচ্ছিলকারকের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়। কারণ এতে খনিজ তেল থেকে ভালমানের যান্ত্রিক এবং রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়। প্রচলিত ভাষায় আরো অনেক তেল আছে যা উল্লেখিত তেলেরই বংশধর বা রূপ, যেমন-ষান্ডার তেল, কটুতেল, পাম তেল ইত্যাদি।
আমরা দৈনন্দিন জীবনে উপরে উল্লেখিত সব তেলই কমবেশি ব্যবহার করি। তবে একশ্রেণীর মানুষ যে তেল ব্যবহার করে সেই তেলের কোন রং নেই, বর্ণ নেই, সংজ্ঞা বা বৈজ্ঞানীক ব্যাখ্যাও নেই। এই তেল মুখ থেকে নিসৃত হতে পারে, আচার আচরনে হতে পারে। আজকের দিনে মানুষ জৈব বা খনিজ অথবা উদ্ভিজ তেলের চেয়ে মুখ নিসৃত তেলই বেশি ব্যবহার করে। মুখ নিসৃতি বা আচার আচরনের যে গুনটাকে আমরা তেল বলি সেটা অনেকটা সিনথেটিক তেলের মত কাজ করে। মানুষ এমন সব আচার আচরন করে যে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌছাতে তার কোন অসুবিধা হয় না। অযোগ্য মানুষ স্রেফ তেলের কারনে সমাজে এখন নামী-দামী ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠছেন। লেখালিখি না করেও লেখক হন, সাংবাদিকতার ‘সা’ না বুঝলেও বিশিষ্ট সাংবাদিক হন, সম্পাদকের ‘স’ না বুঝেও সম্পাদক বনেযায়, তেলের গুণে হয়ে ওঠেন একাধিক সংগঠনের কর্তাব্যক্তি। রাজনীতিতে তেলের মহিমা কত তা বাঙ্গালিকে আর বলে বুঝাতে হবে না। আমাদের রাজনীতিকরা তেলবাজদের কারনে ঠিকমত পথও চলতে পারে না। পারবেই বা কিভাবে, তাদের চলার পথ যে পিচ্ছিল করে রেখেছে। তাইতো অনেক ক্ষেত্রে যোগ্যরাও তৈলবাজী করতে বাধ্য হয় নিজের অবস্থান টিকিয়ে রাখতে।
তবে প্রসিদ্ধ তেলবাজ সেই হয় যে পরিমিত তেল দিয়ে একবার সাফল্যের চূড়ায় উঠে বসে পথটাকে তেল দিয়ে পিচ্ছিল করে রাখেন। এবার আপনি চূড়ায় বসে সুবিধাদী ভোগ করবেন আর কেউ যাতে সেখানে পৌছাতে না পারে সেই জন্য তেল দিয়ে পথটাকে পিচ্ছিল করে রাখলে দেখবেন নতুন যারা উঠতে চাইছে তারা উঠতে পারবে না, পিছলে পড়ে যাবে। তার মধ্যেও আপনার মত চতুর ধান্ধাবাজ যারা থাকবে তারা চেষ্টা করবে উঠতে, অনেকে সফলতার দাড় গোড়ায়ও পৌছে যাবে। তবে পারবে না, কারন কি জানেন? একটা গল্প প্রচলিত আছে, সকল নরকে পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে শুধু একটা বাদে। একজন জিজ্ঞেস করলো যে ঐ নরকটায় কেন পাহারা বসানো হলো না, ওখান থেকে যদি কোন নরকবাসী উঠে এসে স্বর্গে ঢুকে যায়? তখন অধিকর্তা বললো-কোন সমস্যা নেই, ওখানে আছে বাঙ্গালিরা। তখন আগ্রহী ব্যক্তি বললো, বাঙ্গালিরা কি এত ভালো যে তারা উঠে আসবে না? তখন অধিকর্তা বললেন, আসবে। তারা চেষ্টাও করবে। একজন যখন একটু উঠবে তখন ঐ ব্যক্তির পা ধরে আরেকজন উঠার চেষ্টা করবে, এভাবে তার পা ধরে আরেকজন, একপর্যায়ে প্রথম ব্যক্তিটি আর ভার সহ্য করতে না পেরে হাত ফসকে পড়ে যাবে। তাই আমরা নিশ্চিন্তে থাকি যে ওখান থেকে একা কেউ উঠে আসতে পারবে না। তাই চূড়ায় আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন তবে খেয়াল রাখবেন আপনার তেলে যেন আপনি নিজেই পিছলে না যান।

Sunday, August 18, 2019

রাজশাহীর পথে পথে একদিন... স্বাধীনতার এতটা বছর পরেও কেন রাত বারোটায় শিশু দুই ভাইয়ের দুই দোকানে কাজ করতে হয়!

মানুষ আমি আমার কেন পাখির মত মন...তাইরে নাইরে করে গেলো সারাটা জীবন.....। আসলেই মানুষের মন পাখির মত। এক ডালে বসে থাকতে কারোরই ভালো লাগে না। যেমনটা আমার ভালো লাগে না। বিভিন্ন ছল-ছুতায় বেরিয়ে পরতে চায় মন। ঈদ পরবর্তী সবাই কোন না কোন জায়গায় ঘুরতে যাচ্ছে। জামাই, ওবিডিয়েন্ট জামাই, মোষ্ট ওবিডিয়েন্ট জামাই, ডোমেস্টিক জামাইদেরতো কথাই নাই। বন্ধু-বান্ধব কয়েকজন একসাথে হলেই সুর ওঠে চল বেরিয়ে পড়ি। মুক্ত ভাবে ঘুরার বাসনা সবার মধ্যেই থাকে যেমনটা আমার মধ্যেও আছে। তাইতো ঈদ পরবর্তী ছুটিটা কিভাবে কাটানো যায় সে নিয়ে চিন্তা করতে করতে বন্ধু শামীম সরদার বললো-চলো রাজশাহী ঘুরে আসি। সোনামসজিদ, পদ্মা নদী দেখে আসলে মন্দ হয় না। যদিও আমরা পদ্মা পাড়ের মানুষ। পদ্মার শান্ত-ভয়ানক রুপ দেখে দেখে বড় হয়েছি। তবুও আমাদের পদ্মা আর রাজশাহীর পদ্মা কেমন তা দেখা যেতেই পারে। যেমন কথা তেমন কাজ। বন্ধু শামীম সরদারের গাড়ি নিয়ে রাত বারোটায় বেরিয়ে পরলাম রাজশাহীর উদ্দেশ্যে।
বন্ধু শামীম সরদারের অফিস থেকে শাক-খিচুরি খেয়ে রওয়ানা দিলাম আমরা। পতে পথে গল্প, রাতের দৃশ্য হৃদয়ে ধারণ করতে করতে চলছে গাড়ি দূর্বার গতিতে। রাতের ভ্রমনে কিছুক্ষণ পর পর চা না হলে চলে না। মাদারীপুরের পথে আর চায়ের জন্য থামলাম না আমরা। গাড়ি গিয়ে থামলো ফরিদপুরের মুন্সির বাজার বাইপাসের মোড়ে। ফরিদপুর মুন্সির বাজার বাইপাসে বিশাল এক স্মৃতিস্তম্ভ আছে। এটা নুরু মিয়ার স্মৃতির উদ্দেশ্যে তৈরী। নুরু মিয়া বাইপাসে নেমে সদরপুরের দিকে যে রাস্তাটা চলে গেছে সেদিকে একটা চায়ের দোকান খোলা। দোকানটি কদম গাছের নিচে। দোকানি ধুয়ে মুছে বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। গভীর রাতের চায়ের অনুভূতির একটা দাম আছে, তাই চায়েরও আলাদা দাম থাকে। সচরাচর যে চা আমরা ৫ টাকায় পাই সেই একই চা খেতে হলো দশ টাকা করে। দশ টাকা নিলেও আমাদের কোন আক্ষেপ নেই, আমরা চা নিলাম। দোকানির সাথে গল্পের ফাঁকে ফাঁকে চলছে চা পান। বাইপাসের গুরুত্ব শুনালেন আমাদের। আগে ফরিদপুরের এই রাস্তায় অনেক দূর্ঘটনা ঘটতো। রাস্তার একটা মোড় আছে যেখানে গাড়ি আসার সাথে সাথে চালকরা নাকি সাত আটটি রাস্তা দেখতো চোখের সামনে। দ্বিধাদন্দে ভূগে সবসময় মাঝের রাস্তা দিয়েই গাড়ি ঢুকিয়ে দিতো আর তাতেই ব্যাস! গাড়ি গিয়ে পড়তো লডা ক্ষেতে! পরবর্তীতে এই বাইপাস করায় অনেক দূর্ঘটনা কমে গেছে শুনালো দোকানি।
চা খেয়ে রাস্তা পাড় হয়ে বাইপাসের পাসের একটি দোকানের সামনে স্টিলের বেঞ্চিতে বসলাম। গভীর রাতের শুনসান নিরবতা ভাঙ্গছে অচেনা গাড়ির সাই সাই শব্দ। আপন শহর থেকে বহু দূরের কোন জায়গার নিরবতা অন্যরকম অনুভব হয়। যেখানে আমি কাউকে চিনিনা, কেউ চেনেনা আমাকেও! বসে বসে অনুভব করলাম, গভীর রাতের গাভীর দুধের এক কাপ ধূমায়ীত চা হৃদয়ে কতটা প্রশান্তি বয়ে আনতে পারে তা ভাষায় প্রকাশ করার নয়! আমিও প্রকাশ করতে পারছি না সেই অনুভূতির কথা। সুযোগ হলে নিজেই কখনো চেখে দেখবেন কেমন অনুভূতি।
এখানে বসে বসে গভীর রাতের সৌন্দর্য অনুভব করলে হবে না, যেতে হবে বহু দূর! তাই চালক তারা দিলো, ওঠেন আগাই আমরা। আবার চলতে থাকলাম আমরা। মুন্সির বাজার থেকে বাইপাস দিয়ে রাজবাড়ীর মোড় পার হয়ে আমরা রাজবাড়ীর উপর দিয়ে কুষ্টিয়ার দিকে চলছি। কুষ্টিয়া আর রাজবাড়ীর মাঝামাঝি জায়গায় বেশ লোক সমাগম দেখে ভাবলাম কোন ডাকাতির ঘটনা। পরক্ষণেই দেখি একাধিক পুলিশের গাড়ি, কিছু মাইক্রোবাস দাড় করা। পুলিশের গাড়ি দেখে বুঝলাম কোন একটা ঝামেলা হয়েছে নিশ্চই! কাছে যেতেই দেখি একটা বড় বাস রাস্তা থেকে ছিটকে পাশের খালে পড়ে আছে। একই বয়সের কিছু যুবক ভেজা অবস্থায়। কেউ রাস্তার পাশে বসে আছে, কেউ পুলিশের কাছে জবানবন্দী বা স্বজনের বা আহত সঙ্গীর তালিকা দিচ্ছে, পুলিশ গাড়ির বনেটের উপর ডায়রি রেখে লিখছে। রাস্তার পাশে অসংখ্য স্কুল ব্যাগের মত ভারি ব্যাগ রাখা আছে। কেউ কেউ ব্যাথায় কাতরাচ্ছে। দূর দূরান্ত থেকে লোকজন হাতে লাইট নিয়ে এগিয়ে আসছে। পরবর্তীতে শুনেছি ওটা একটা টুরিস্ট বাস ছিলো। স্কুল-কলেজের ছাত্রদের নিয়ে কোন জায়গায় বেরাতে যাচ্ছিলো। এমন ফাঁকা রাস্তায় দূর্ঘটনায় পড়া মানে চালক হয় ঘুমিয়ে পড়েছিলো নয়তো নেশা করেছিলো। যাহোক, আমরা আর ঝামেলায় না জড়িয়ে চলতে থাকলাম। আমরা অমানবিক নই কিন্তু! এখানে পুলিশের গাড়ি আছে, একাধিক মাইক্রোবাস হয়তো পুলিশই এনেছে, তাই আমাদের দর্শক হয়ে ভীর বাড়ানো ছাড়া কোন কাজ হতোনা। আর আমরাও যেহেতু অনেক দূর যাবো, এমন পরিস্থিতি দেখলে হয়তো আমাদেরও খারাপ লাগতে পারে, যার ফল হিসাবে আমাদেরও কোন সমস্যা হতে পারে, সেই ভেবে আমরা চলতে থাকলাম।   
আমরা কুষ্টিয়া হয়ে পাবনার দিকে যাচ্ছি। লালন সেতু পার হতেই বিশাল বিশাল ইমারত চোখে পড়লো। আলো ঝলমলে ইমারত দেখে বন্ধু শামীম বললো, এগুলো কি? আমি মুহুর্তেই বুঝেগিয়ে বললাম, এগুলোই বাশি কান্ড! শামীম সরদার বললো, বালিশ কান্ড মানে কী? বালিশ কান্ড মানে হলো একটা বালিশের মূল্য সাত-আট হাজার আর তা এই ভবনে উঠাতে বলদ বাবদ লাগছে ছয়-সাত হাজার, সেই রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র! চলতে চলতে আমরা পাবনা থেকো নাটোরের দিগের রাস্তার মোড়ে গিয়ে আবার যাত্রা বিরতি দিলাম। মোড়েরর চায়ের দোকানে আমাদের মত আরো অনেকেই চা খাচ্ছে দেখলাম। শ্রমিক যারা আছে তারা হয়তো পেটের দায়ে আর আমরা মনের দায়ে গভীর রাতে রাস্তায়। আমরা চা খেয়ে আবার চলতে শুরু করলাম। গাড়িতে উচ্চ ভলিউমে গান চলছে বিরতিহীন ভাবে। বাংলা-হিন্দী কোনটাই বাদ যাচ্ছে না। শুধু ইংরেজী গান শুনিনি! মনির খানের কলিজা কাটা বিচ্ছেদ, গুরু জেমসের, ইন্দ্রানীর গান, নতুন শিল্পীদের, সবার গানই ভালো লাগবেছ। গভীর রাতের গান বলে কথা। রাস্তার ধারের দোকানগুলো সবই বন্ধ। মাঝে মাঝে নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরা হাটাহাটি করছে। এছাড়াও আছে কিছু বেওয়ারীশ কুকুর। নাটোরের বুকচিরে চলছে আমাদের গাড়ি। নাটোর পার হতে হতে আমাদের সূর্যমামা উকি দিতে শুরু করেছে। রাস্তায় প্রচুর গাড়ি চলছে। বড় বড় বাস, আমাদের মত অনেকেই প্রাইভেট কার, জীপ, মাইক্রো নিয়ে ছুটেছে। উদ্দেশ্য হয়তো একেক জনের একেক ধরনের। কখনো আমরা গাড়িকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছি আবার কখনো আমাদের পাশ কাটিয়ে সাইসাই করে চলে যাচ্ছে কেউ কেউ। রাজশাহী পৌছাতে পৌছাতে আমাদের ভোর হয়ে গেলো। রাজশাহী ঢুকে দেখি রাস্তায় সবজি বিক্রেতারা কেনাবেচা করছে। আমরা একটা হোটেলে উঠলাম। সারা রাতের জার্ণি! শরীর আর মানতে চাইছে না। একটু বিশ্রাম না নিলে হবে না। ঘুম হয়তো আসবে না, তবুও শরীরটাকে টান টান করা আরকি!
একটু বিশ্রাম নিয়ে উঠে পড়লাম আমরা। হেটেল থেকে বেরিয়ে আগে নাস্তা সারলাম। সকাল সকাল ভাত-ডাল মেরে দিলাম! এবার একটু ঘুরাঘুরি করা দরকার। প্রথমেই গাড়ি নিয়ে দর্শনীয় কিছু স্থান দেখে নিলাম কিন্তু নামলাম না। শুক্রবার হওয়ায় কোন কিছুই তেমন খোলা নেই। বরেন্দ্র যাদুঘর বন্ধ। সবকিছুই দেখলাম কিন্তু নেমে দেখলাম না। গাড়িতে বসেই মুখটা দেখলাম। মুখচ্ছবিতে যদিও সকল সৌন্দর্য বিরাজ করে না, তবে মুখচ্ছবি দেখলে অনেক সময় দেখার বড় একটা অংশ পূর্ণ হয়, আমরাও তেমনি করছি। ঘুরতে ঘুরতে গেলাম পদ্মা পাড়ে।
পদ্মা পাড়ের মানুষ আমরা। তবুও রাজশাহী গিয়ে পদ্মার নাম শুনে চলে গেলাম দেখা করতে পদ্মার সাথে! রাজশাহী ঈদগা মাঠের পাশে গাড়ি রেখে তীরে নামলাম। বিশাল শহর রক্ষা বাধ পাড় হয়ে নিচে নামতেই চোখে পড়লো মুক্তমঞ্চ। চমৎকার করে সাজানো মুক্তমঞ্চ। জেলাটি শিল্প সংস্কৃতিতে অনেক আগানো একটি শহর। অনেক পুরাতন স্থাপনা নজরে আসলো। মুক্তমঞ্চটি দেখলেই বুঝাযায় এখানে মানুষ শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা করে। কারন এখানে রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করার মত স্পেস নয়। শিল্প-সংস্কৃতি চর্চায় যে পরিমান মানুষ হওয়ার কথা তার চেয়ে একটু বেশি জায়গা নিয়ে করা। খুবই শৌল্পিক নকশায় করা হয়েছে যা অনেকটা রাজধানীর ধানমন্ডি রবীন্দ্র সরোবরের আদলে তৈরী। মুক্তমঞ্চের পাশ দিয়ে হাটার মত রাস্তা করা। মানুষের শরীর স্বাস্থের কথা চিন্তা করেই হয়তো এই ওয়াকওয়েটা তৈরী করেছে। এর পর নদীর বিশাল অংশের শুরু। শুরুটা কাশবনে বা কাইয়া বন দিয়ে আবৃত। একটু দূরেই বিশাল পদ্মা নদী। কাশবনে বেশ ‍কিছু দোকান গড়ে উঠেছে। প্লাস্টিকের চেয়ার পেতে দিয়েছে ফুচকা-চটপটির দোকানিরা। স্কুলে কলেজে পড়ুয়া অনেককে দেখা গেলো। আছে মধ্য বয়সীসহ অনেক মানুষ। আমরা যেদিন গিয়েছি সেদিন শরতের প্রথম দিন। আমরা যেমন বলি ফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ বসন্ত তেমনি কাশফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ শরৎ। কাশবন এখন ঘণ সবুজ। কিছুদিন পরই হয়তো সফেদ সাদা কাশফুল শোভা পাবে ঘাসের চুড়ায়। কাশবনের পরেই পদ্মার শুরু। এর পর দিগন্ত জোরা আকাশ। অপর প্রান্ত পর্যন্ত যতদূর চোখ যায় শুধু পদ্মাই। শরীয়তপুরের উপর দিয়ে বয়ে গেছে পদ্মা, মেঘনা, কীর্তিনাশা নদী। পদ্মার একই রুপ, একই জল, প্রবাহও একই রকম। শুধু দৃশ্য একেক জায়গায় একেক রকম। অনুভবও একেক জায়গায় একেক রকম। পদ্মাপাড়ের মানুষ হয়ে পদ্মা দেখছি নয়ন ভরে শুধু আমাদের পদ্মা থেকে অনেক দূরে গিয়ে। 
পদ্মার পাড় দিয়ে হাটতে হাটতে একটা দোকানের সামনে গাছের নিচে পাতা চেয়ার-টেবিলে গিয়ে বসলাম। চেয়ারে বসতেই এক সেবক আসলো আমাদের সামনে। আমরা যেখানে বসেছি তার পাশ দিয়েই ছোট একটি পদ্মা বয়ে চলেছে। এর পর চরের বুকে কাশবন তারপর প্রমত্তা মূল পদ্মা নদী। পদ্মার শাখাটা দিয়ে ট্রলারে করে মানুষ ঘুরছে। সেখানে বসে বসে সৌন্দর্য খালি মুখে দেখলে কেমন হয়! তাই শামীম সরদার আর আমি কোল্ড কফি নিলাম। অল্প অল্প কফি খাচ্ছি আর বেশি সময় পার করে বেশি বেশি সৌন্দর্য দেখছি।পদ্মাকে ঘিরে এখানে তীর জুড়ে বিশাল ব্যবসা বাণিজ্য গড়ে উঠেছে। দোকানের সংখ্যা ও সাজ সজ্জা দেখলেই বুঝাযায় এখানে বিশাল এক বাণিজ্য গড়ে ইঠেছে যা দেশের মূল অর্থনীতিতে স্পর্শ করে। পদ্মা আমাদেরও আছে। কিন্তু আমাদের নেই সিদ্ধান্ত নেয়ার নেতা, নেই আন্তরিক আমলা। আমাদের পদ্মাকে ঘিরে শুধুই হাহাকার। ভাঙ্গছে ভাঙ্গছে বলে আমরা গলা ফাটাই। অথচ এখানে পরিকল্পিতভাবে পদ্মাকে নিয়ন্ত্রণ করে গড়ে উঠেছে ব্যবসা বাণিজ্য। আমরা যদি আমাদের পদ্মাপাড়কে এমন সুন্দর করে শাসন করে পর্যটন কেন্দ্র করে দিতাম তবে কক্সবাজার থেকে মানুষ আসতো পদ্মার রূপ দেখতে। পর্যটন এমন একটা শিল্প যা করে বহু দেশ এগিয়ে গেছে। বহু জেলার চিত্রই বদলে গেছে পর্যটনের কারনে। আমাদের দেশে সেই ছেলে কবে হবে, যে কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে? প্রশ্নটা বার বার মনে দোলা দিলো। উত্তর কেউ দিবে না সেটাও হৃদয় বলে দিলো আমাকে। তাইতো বিশ্বের সবচেয়ে বড় সৈকত কক্সবাজার থেকে আমরা কাঙ্খিত অর্থ উপার্যন করতে অক্ষম, তেমনি পদ্মার বড় একটা অংশ আমাদের থাকতেও সেটার সদব্যবহার করতে পারিনি।
দুপুর হয়ে গেছে। পেট জানান দিচ্ছে কৃমি মরে যাচ্ছে তোর! এবার কিছু খেতে হবে। নদীর পাড় থেকে চলে গেলাম হোটেলে। পদ্মাপাড়ের জেলায় এসে পদ্মার ইলিশ খাবো না সেকি হয়? তাই ইলিশ মাছ দিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে একটু বিশ্রামে গেলাম। সারা রাত জেগে সকালে বিশ্রামের নামে শরীর যতটুকু চার্য দিয়েছি তাতে আবার একটু ক্লান্ত অনুভব হচ্ছে। তাই দুপুরের খাবার খেয়ে বিশ্রামে গেলাম। সন্ধায় উঠে বেরিয়ে পড়লাম রাস্তায়। গাড়িতে করেই এদিক সেদিক ঘুরছি আর দেখছি। মাঝে মাঝে থেকে থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। প্রবল বর্ষণ বলা যাবে না। গুরিগুরি টাইপ বৃষ্টি। তাই কোথাও নামার চেয়ে গাড়িতে বসেই রুপ দেখা ভালো বলে মনে হলো।
রাত বারোটা বেজে গেছে। গভীর রাতই বলাযায়! রাজশাহী একটা মহানগর। মহানগরে রাত বারোটা তেমন গভীর রাত মনে হয়নি। মূল শহরে এখনও কিছুটা মানুষের চলাচল চোখে পড়ে। ঘুরতে গেলে এতটা আগে আমরা কখনোই বিশ্রামে যাই না। রাতের খাবার খাওয়া দরকার কথাটা মনে পড়তেই মনে হলো এখানে কালাইর রুটির খুব সুনাম আছে। কিছুদিন আগে আমাদের কয়েকজন আইনজীবী ভাই বেড়াতে এসেছিলো। তারাও কালাইর রুটি খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছে। সাথে সাথে ফোন দিলাম রোকনকে। রোকন বললো এটা উপ-শহরে পাওয়া যায়। এত রাতে উপ-শহর কোনদিকে খুজতে খুজতে শামীম সরদারের চোখে পড়লো একটা ঝুপড়ি ঘর। সেখানে এক মহিলা কি যেন ভাজছে। গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞেস করতে করতে নিজেদের চোখেই ধরা পড়লো যে, মহিলা মোটা মোটা কালচে বর্ণের রুটি ভাজছে। রেল লাইনের পাশে রেল কর্তৃপক্ষের জায়গায় বসেছে দোকান। আমরা রুটি চাইলে আমাদের জানায় আজ আর হবে না। দুজন যুবক বসা। তাদের দশটা রুটির অর্ডার আছে। এর পর আর খামির করা নাই তাই দেয়া যাবে না। আমরা অনেক দূর থেকে এসেছি শুনে এবং আমাদের আগ্রহ দেখে চেয়ার দিলো বসতে। কারিগর বা দোকানি একজন হিলা, সেবক হিসাবে মহিলাকে সহায়তা করছে ছোট্ট শিশু এই সেই কালাইর রুটি! আমরা যখন গেছি তখন বেচাবিক্রি শেষ তবুও আমাদের অনুরোধে নতুন করে আটার খামির করে তিনটি রুটি তৈরী রে দিলো খাওয়ার মত উপাদানও তেমন নেই! শুধু পিয়াচ কুচি আগ্রহ দেখে আমাদের কিছু বেগুন ভর্তা রে দিলোদোকানি জানালো, বিভিন্ন প্রকার ভর্তা, হাসের মাংস, গরুর বট, গরুর মাংস দিয়ে খেতে হয়। সব বেচা হয়ে গেছে। পিয়াচকুচিটা ফ্রি দেয়া হয়, আমাদের কাছ থেকেও পেয়াজকুচির দাম নিলো না। শামীম সরদার সাথে পেলো গরুর বট বা ভুরি! আমি ওটা কোন কালেই খাইনি, আজও খেলাম না ত্রিশ টাকা রে প্রতিটি রুটির দাম। রুটির চেহারা দেখে মনে হলো খাদ্যাভাব লে হয়তো ত্রিশ পয়সায়ও কিনতাম না, কিন্তু নাম ডাকের কারনে তা ত্রিশ টাকায়ই কিনে খেলাম, তাও চেটেপুটে! মোটা, কালচে রুটিগুলো আমাদের এলাকার চডা পিঠা বা চাপটির মত যা আধুনিক মানুষেরা দোসা বলে তেমন দেখতে রুটিগুলো। স্বাদের কথা বললে বলবো-একেবারে মন্দ নয়, তবে প্রতিদিনের জন্য নয়।
আমাদের যে রুটি-পানি এগিয়ে দিয়ে সেবা করলো সেই সেবক ছেলেটা দেখতে খুবই ছোট। আমাদের চা-পানি এনে দিলো, এগিয়ে দিলো। আমাদের তিনটা রুটি দেয়ার পর একটা রুটি ছেলেটাকে খেতে দিলো দোকানি মহিলা। শামীম সরদার বটের প্লেট থেকে এক টুকরো মুখে দিয়ে ভালো না লাগায় রেখে দিয়েছিলো। সাথে তার চিরাচরিত অভ্যাস অনুযায় প্রায় অর্ধেকটা রুটিও রেখে দিলো। সেবক ছেলেটা একটু দূরে বসে খাচ্ছে। আমি ওকে ডাক দিয়ে বললাম, বটটা নষ্ট হয়নি, আর খাবেও না। তুমি চাইলে খেতে পারো। শামীম বললো রুটিটাও নিয়ে যাও আমি আর খাবো না। ছেলেটা হাসি মুখে নিয়ে খেতে বসলো। এরই মাঝে পাশের চায়ের দোকানের আরেক সেবককে ডাক দিলো। ছেলেটা আসার পর তার অর্ধেকটা খাবার খেতে দিলো। দোকানি মহিলা তখন বললো, এটা ওর ভাই। ওরা দুই ভাই এই দুই দোকানে কাজ করে। দেখে খুব কষ্ট লাগলো আবার গর্বও হলো যে কাজ করে খায়। সবচেয়ে বেশি অবাক লাগলো ছোট ভাইয়ের প্রতি মমত্ববোধ দেখে। ভাইর জন্য বটের বেশিরভাগ অংশ রেখে খেয়েছে। আমাদের পাশের বেঞ্চে বসেই যখন ছোট্ট ছেলেটি খেতে শুরু করলো প্রথম লোকমা মুখে নিয়ে কিছুটা চিবুনোর পরে গিলার সময় গলায় আটকে গেলো। 
আমি দোকানের একটু বাইরের অংশে খোলা আকাশের নিচে ছেলেটার দিকে মুখ করে চেয়ারে বসে চা খাচ্ছিলাম। শামীম সরদার ছেলেটাকে পিছনে রেখে আমার দিকে মুখ করে চা খাচ্ছে। ছেলেটার ভাই গেছে পানি আনতে। ওর গলায় খাবার আটকে গেছে, চোখগুলো বড় বড় হয়ে মনে হচ্ছে বেরিয়ে যাচ্ছে এবং নিঃস্বাস নিতে পারছে না দেখে আমি দূর থেকে শামীমকে বললাম আমাদের পানির বোতলটা ওকে এগিয়ে দিতে। আমাদের পানির বোতলের মুখ খোলাই ছিলো। শামীম তারাতারি ঘুরে বোতলটা ছেলেটার হাতে দিয়ে বললো পানি খাও। ছেলেটা প্রচন্ড জোড়ে পানির বোতলের মুখ খোলার জন্য বোতলের মুখ মোচরাচ্ছে। আমি তখন ঐ দৃশ্যটা দেখে ওকে বললাম, বোতলের মুখ খোলাই আছে, তুমি পানি খাও তারাতারি। পরে পানি খেয়ে গলা থেকে নামালো। কালাইর রুটি একটু শক্ত শক্ত। বাচ্চা ছেলে, তারাহুরা করে খেতে গিয়ে গলায় আটগে গিয়েছে। পানিটা খাওয়ার পরে ওর চোখ দিয়ে পানি ঝড়ে পড়লো। এটা কোন কান্নার বা আবেগের অশ্রু নয়, ছোট ছেলেটার জন্য কষ্টের অশ্রু। ওর খাবার নেয়া দেখে এবং চোখের অশ্রু দেখে আমার হৃদয় নিংড়েও অশ্রুক্ষরণ হলো কিন্তু প্রকাশ করলাম না। ওকে বললাম, তুমি আস্তে আস্তে খাও, পানিটা তোমার কাছেই রাখো। পরদিন চলে আসলাম নিজ জেলায়। কিন্তু ছেলে দুটির মায়াভরা মুখ আর ছোট ছেলেটার গলায় খাবার আটকে যাওয়ার ও অশ্রু ঝড়ার দৃশ্যটা হৃদয় থেকে মুছতে পারছি না। আমরা কবে দারিদ্রতা গলা থেকে নামাতে পারবো? দারিদ্রতা আমাদের গলায় আটকে পানির অভাবে দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমরা কিছুই করতে পারছি না। আর কবে পারবো। স্বাধীনতার এতটা বছর পরেও কেন রাত বারোটার পরে শিশু দুই ভাইর দুই দোকানে কাজ করতে হয়!